বহু বিচিত্র শখ থাকতে পারে মানুষের, কারো শখ থাকে পুরোনো দিনের দূর্লভ বিভিন্ন স্মারক কিংবা মুদ্রা সংগ্রহ করা, কারও শখ থাকে বিভিন্ন ধরনের পাখির বাসা সংগ্রহ করা, মাছ শিকার করা কিংবা দূর্লভ গাছপালা সংগ্রহ করা। ডাকটিকেট সংগ্রহ করা এমনই একটি শখ। শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর সব দেশেই ডাকটিকেট সংগ্রাহক আছেন। সারাবিশ্বে এখন প্রায় দশ কোটি ডাক টিকেট সংগ্রাহক আছেন বলে ধারণা করা হয়।
অনেকে ডাক টিকেটে সংগ্রহের শখকে রাজাদের শখ বলেন, কারণ বৃটেনের রাজা পঞ্চম ও ষষ্ঠ জর্জ, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টসহ অনেক অভিজাত শ্রেণীর লোকের ডাকটিকেট সংগ্রহের শখ ছিল এবং আছে।
ডাক টিকেট সংগ্রহ করাটাকে কেবল একটি শখ হিসেবে দেখাটা ঠিক হবে না। একটি ডাক টিকেটে দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রকৃতি ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটানো হয়। তাই ডাকটিকেট সংগ্রহ করতে গিয়ে একজন সংগ্রাহক বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন।
কেবল ডাক টিকেটই নয় পোস্ট কার্ড এবং বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত স্মারক খামও সংগ্রহে রাখেন সৌখিন ডাক টিকেট সংগ্রাহকরা।
শুরুর কথা
বৃটেনের রোল্যান্ড হিলকে ডাকটিকেটের জনক বলা হয়। ১৮৩৭ সালের কথা, সে সময় প্রেরককে নয় প্রাপককেই ডাক মাশুল দিতে হত। চিঠির পাতার সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে ডাক মাশুল নির্ধারিত হত। প্রাপক অনেক সময় বিভিন্ন টালবাহানা করে ডাক মাশুল দিতে চাইতো না। এসব অসুবিধা দূর করতে রোল্যান্ড হিল ডাক বিভাগের সংস্কারে বিভিন্ন প্রস্তাব আনেন, যার অন্যতম ছিল ডাক টিকেটের প্রচলন।
১৮৪০ সালে তাঁর প্রস্তাবানুসারেই প্রাপকের পরিবর্তে প্রেরক কর্তৃক ডাকমাশুল দেবার রীতি প্রবর্তন করা হয়। ওজনের ভিত্তিতে ডাক মাশুল দেবার পদ্ধতিও এ সময় চালু করা হয়।
প্রথম
বিশ্বের প্রথম ডাক টিকেট: ১৮৪০ সালের ১লা মে বৃটেনে বিশ্বের প্রথম ডাকটিকেট পেনি ব্ল্যাক প্রকাশিত হয়। বৃটেনের রানীর প্রতিকৃতি ছিল সেই ডাকটিকেটে।
উপমহাদেশের প্রথম ডাকটিকেট: ১৮৫২ সালে বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে উপমহাদেশের প্রথম ডাকটিকেট চালু হয়। উল্লেখ্য এটি এশিয়ারও প্রথম ডাকটিকেট।
ভারতের প্রথম ডাকটিকেট: সিন্ধু প্রদেশের ডাকটিকেটের ধারাবাহিকতায় ১৮৫৪ সালে ভারতের প্রথম ডাক টিকেট প্রকাশিত হয়।
পাকিস্তানের প্রথম ডাকটিকেট: ভারত ভাগের পর ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম ডাকটিকেট প্রকাশিত হয়। এর পূর্ব পর্যন্ত বৃটিশ ভারতের ডাকটিকেটের ওপর ইংরেজীতে পাকিস্তান লিখে কাজ চালানো হচ্ছিল।
বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকেট: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ২৯শে জুলাই বাংলাদেশর প্রথম ডাকটিকেট প্রকাশিত হয়। লন্ডন প্রবাসী ভারতীয় বাঙালী বিমান মল্লিক বিনা পারিশ্রমিকে আটটি ডাকটিকেটের ডিজাইন করে দেন। ১০ পয়সা, ২০ পয়সা, ৫০ পয়সা, ১ রুপি, ২ রুপি, ৩ রুপি, ৫ রুপি এবং ১০ রুপি মূল্যমানের আটটি ডাকটিকেটের ডিজাইন করেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের সাহায্যার্থে ১০ রুপির ডাক টিকেটের ওপর তিনি লিখে দেন ‘Support Bangladesh’।
এখন স্বাধীন বাংলাদেশে ২৯শে জুলাই ডাকটিকেট দিবস হিসেবে পালিত হয়।
ডাক টিকেট সংগ্রহ:
পারস্পরিক বিনিময়, পুরনো ডাকটিকেটের দোকান এবং পরিচিতজনের পাঠানো চিঠি ছাড়াও জিপিও-তে অবস্থিত ফিলাটলিক ব্যুরো থেকে ডাক টিকেট সংগ্রহ করা যেতে পারে। ঢাকা জিপিও-র নিচ তলায় ফিলাটেলিক ব্যুরোর অবস্থান। সর্বশেষ প্রকাশিত ডাকটিকেট, স্মারক ডাকটিকেট, স্মারক খাম ইত্যাদি পাওয়া যায় এখানে।
খাম থেকে ডাক টিকেট সংগ্রহ
খাম থেকে কখনো টেনে ডাকটিকেট সংগ্রহ করার চেষ্টা করা উচিত নয়। খামের যে অংশে ডাক টিকেট লাগানো আছে সে অংশটুকু কেটে কিছু সময়ের জন্য ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর ডাকটিকেট আলাদা করে পেছনের আঠা ছাড়িয়ে বা ধুয়ে নিতে হবে। এরপর ডাকটিকেটটি নিউজপ্রিন্ট কাগজে চাপ দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। সবশেষে দু’টি কাগজের মাঝে ডাকটিকেট রেখে ইস্ত্রি করে শুকিয়ে নিলে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়।
এলবাম:
ডাকটিকেট রাখার জন্য বিশেষ ধরনের এলবাম পাওয়া যায়। প্লাস্টিক বা সেলোফেনের ফিতায় তৈরি করা ঘরে ডাক টিকেট আটকে রাখার ব্যবস্থা থাকে এসব এলবামে।
বাংলাদেশের ডাকটিকেট:
ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এসব প্রসঙ্গে যেমন ডাকটিকেট প্রকাশিত হয়েছে, তেমন স্মরণীয় ব্যক্তি যেমন, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, এমএজি ওসমানী, আব্দুল হামিদ খান, একে ফজলুল হকসহ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়েও ডাকটিকেট প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রকৃতি, প্রত্নতত্ত্ব, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আর উৎসব নিয়ে ডাক টিকেট প্রকাশিত হয়েছে।
সংগ্রাহকদের সংগঠন
বিপিএস: ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ফিলাটেলিক সোসাইটি বা বিপিএস প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে ১৯৭৮ সালে এটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
বিএনপিএ: ১৯৭৮ সালেই আরেকটি সংগঠন বাংলাদেশ ন্যাশনাল ফিলাটেলিক এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। সংগঠনটির উদ্যোগে একটি ফিলাটেলিক ওরিয়েন্টেশন কোর্স পরিচালিত হয়। এছাড়া সংগঠনটি প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবার ঢাকার মাওলানা ভাসানী জাতীয় হকি স্টেডিয়ামের ২য় তলায় ডাকটিকেট নিলামের আয়োজন করে। সংগঠনটির বিভিন্ন কমসূচিকে স্মরণীয় করে রাখতে ডাক বিভাগও বিভিন্ন সময়ে ডাক টিকেট, পোস্টাল স্টেশনারী এবং বিশেষ খাম প্রকাশ করেছে। সংগঠনটির সাথে যোগাযোগ: জিপিও বক্স নং ৭৯০, ঢাকা-১০০০।
পিএবি: ১৯৮৭ সালে ফিলাটেলিস্টস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা পিএবি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রেশন পাওয়া ডাকটিকেট সংগ্রাহকদের একমাত্র সংগঠন এটি। সংগঠনটির উদ্যোগের ফিলাটেলি ক্লাস, সেমিনার ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রতি মাসের ২য় শুক্রবার সংগঠনটির উদ্যেগে ডাকটিকেট নিলামের আয়োজন করা হয়। স্থান: ৬৮ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, ২য় তলা, সালাম স্ট্যাম্প সেন্টার। পিএবি’র ঠিকানা: ৪১, উত্তর কমলাপুর (২য় তলা), ঢাকা-১২১৭।
এছাড়া রাজশাহী, কুমিল্লা, খুলনা ও চট্টগ্রামেও ফিলাটেলিক সংগঠন রয়েছে।
পোস্টাল মিউজিয়াম: ঢাকা জিপিও’র মূল ভবনেই একটি পোস্টাল মিউজিয়াম বা ডাক জাদুঘর আছে। যেখানে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ডাক ব্যবস্থার ক্রমবিকাশের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া এ জাদুঘরটির একটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ডাক টিকেটের গ্যালারী।